মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের ভূনবীর গ্রামের কাঁচা রাস্তা ধরেই শুরু তার দৌড়। ছোট্ট শরীর। মাত্র তিন ফুট সাত ইঞ্চি উচ্চতা। জন্ম থেকে শারীরিক প্রতিবন্ধী। তবু কেউ তাকে থামাতে পারেনি। তার পরিবার দরিদ্র। অন্য বোনেরা স্বাভাবিক জীবনে বড় হয়েছে, কিন্তু চৈতি বড় হয়েছে অগণিত চোখের মন্তব্য পিঠে নিয়ে। তবুও সে হাসে, দৌড়ায়, পড়ে যায়, আবার উঠে দাঁড়ায়।
চৈতি রানী দেব। বয়স মাত্র ১৩। ভূনবীর দশরথ হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। শৈশব থেকেই দৌড়াতে ভালোবাসে। পা ফসকে পড়ে গেলে কান্না নয়, বরং জেদ জাগে—“আবার দৌড়াব।” সেই জেদই একদিন তাকে নিয়ে গেল জাতীয় স্টেডিয়ামের মাঠে। ৩ অক্টোবর ২০২৫, ঢাকার সেই দিনে ১০০ মিটার দৌড়ে প্যারা অলিম্পিকে চ্যাম্পিয়ন হলো মেয়েটি। যে মেয়েকে অনেকে একসময় করুণা দিয়ে চিনত, আজ তাকে চেনে বাংলাদেশ—চ্যাম্পিয়ন চৈতি।
চৈতির সহপাঠীরা বলে, “ও আমাদের সবার চেয়ে বেশি পরিশ্রম করে। ও পড়ে, আবার খেলাধুলাও করে। স্কুলের মাঠে যখন সবাই দৌড় থামায়, চৈতি তখনও দৌড়ায়। ওর শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, তারপরও ও থামে না। ওর থেকে আমরা শিখেছি—হার মানলে কেউ জেতে না।”
কোচ, স্কুল, পরিবার—সবার ছোটোবেলার ভরসা ছিল তার চোখের ভেতর আগুন। “স্পোর্টস ফর হোপ অ্যান্ড ইন্ডিপেনডেন্স (SHI)” এর প্রশিক্ষক দেব প্রসাদ শীল প্রথম দেখেছিলেন সেই আগুন। তার কথায়, “চৈতি অন্যদের মতো নয়। কিন্তু অন্যদের চেয়ে শক্ত। আমি প্রথমে ভয় পেয়েছিলাম, কীভাবে তাকে নিয়ে কাজ করবো। পরে দেখলাম, চৈতি প্র্যাকটিস করলে কেউ তাকে আটকে রাখতে পারে না। সে একটানা ১ ঘণ্টা ২০ মিনিট জগিং করতে পারে। জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর এবার দুবাইয়ের দৌড় প্রতিযোগিতায় যাচ্ছে। আগামী মাসের ৭ তারিখে সে আন্তর্জাতিক ট্র্যাকে নামবে। শুধু দৌড় নয়, পাশাপাশি বর্শা নিক্ষেপেও অংশ নেবে। তার পাসপোর্ট ফি স্কুলের শিক্ষকরা নিজেদের ফান্ড থেকে দিয়েছে। আমরা চাই, ও দেশকে উজ্জ্বল করে নিয়ে আসুক।”
বাবা সত্য দেব প্রতিদিন মাঠে দাঁড়িয়ে দেখেন মেয়ের অনুশীলন। তার চোখে গর্ব। কিন্তু আছে ভয়ও—অর্থহীনতার। “আমি গরীব মানুষ,” তিনি বলেন, “মেয়ের সব ইচ্ছে পূরণ করতে পারি না। তবু সে স্বপ্ন দেখে। বলে একদিন দেশের পতাকা উঁচু করে রাখবে। কেউ যদি একটু সাহায্য করে, আমার চৈতি একদিন দেশের জন্য বিশ্ব জিতবে।”
গ্রামের মানুষ আজ তাকে দেখে, প্রশংসা করে। একদিন যে পথ দিয়ে চলতে লজ্জা পেত, আজ সেই পথেই তাকে দেখে শিশুরা হাততালি দেয়।
চৈতির কথা খুব ছোট। “আমি দেশকে নিয়ে দৌড়াতে চাই। বাংলাদেশকে জিতিয়ে আনতে চাই।” তার স্বপ্ন বড়। তার সংগ্রাম আরও বড়।
এই অদম্য মেয়েটি এখন দুবাইয়ের পথে। শরীরে দৃষ্টি নয়, শক্তি নেই—কিন্তু মনে আছে পাহাড়ের চেয়েও উঁচু সাহস। হয়তো সেখানেও একদিন লাল-সবুজ পতাকাটি তার হাতেই আকাশ ছুঁবে।
বাপ্পী দেব 














