Dhaka ০২:০০ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৩ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

‘এই অর্জন শুধু আমাদের নয়, দেশের প্রতিটি মেয়ের’

স্পোর্টস ডেস্ক : কাকডাকা ভোরে সূর্যের আলো কেবল ফুটতে শুরু করেছে। বসুন্ধরা কিংস এরেনার মাঠের পাশে একটি বাস থামলো। দরজা খুলতেই একে একে বেরিয়ে এলেন, সবার চুল শক্ত করে বাঁধা, বুট কাঁধে ঝুলছে। সবাই প্রাণোচ্ছ্বল। নেই কোনও ঘুম ঘুম ভাব। বাংলাদেশের নারী জাতীয় ফুটবল দলের জন্য এমন ঘটনা রুটিন হয়ে গেছে। সকাল সকাল উঠে অনুশীলন। সামনে যে স্বর্ণাক্ষরে ইতিহাস লেখার সুযোগ, নষ্ট করার মতো সময় নেই। স্কোয়াডের সামনের দিকে ছিলেন অধিনায়ক আফঈদা খন্দকার। সম্প্রতি বাংলাদেশকে এএফসি এশিয়ান কাপে প্রথমবার তুলতে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি।

১৮ বছর বয়সী ডিফেন্ডার বুকভরা গর্ব নিয়ে বললেন, ‘আমি চাই আমাদের মেয়েরা তাদের উজ্জ্বল পারফরম্যান্সের স্বীকৃতি পাক এবং আমাদের সাম্প্রতিক জয় সেটাই করেছে। কিন্তু আমাদের এই তো কেবল শুরু। আমরা বিশ্বকে দেখাতে চাই, বাংলাদেশ আসলে কী করার সামর্থ্য রাখে।’

 

বাছাইপর্বে তিন ম্যাচে ১৬ গোল দিয়েছে বাংলাদেশ, খেয়েছে মাত্র একটি। তিন ম্যাচে ৯ পয়েন্ট নিয়ে ‘সি’ গ্রুপের খেলা শেষ করেছে শীর্ষে থেকে। আগামী বছর জাপান, চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দলের সঙ্গে খেলবে। সেখানে শীর্ষে থাকতে পারলে মেয়েদের বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে খেলার সুযোগ পাবে, এমনকি অলিম্পিক গেমসে খেলার স্বপ্নও দেখতে পারে। দেশের ফুটবল যাত্রায় সেটা হবে বিরাট মাইলফলক।

ফিফা বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়েও বড় লাফ দিয়েছে বাংলাদেশ। ২৪ ধাপ লাফিয়ে ১০৪তম। সবশেষ প্রকাশিত র‌্যাঙ্কিংয়ে সবচেয়ে বেশি উন্নতি করেছে তারাই

বাংলাদেশ অধিনায়ক আফঈদা খন্দকার বললেন, ‘এই অর্জন কেবল আমাদের নয়- এটা বাংলাদেশের প্রত্যেক মেয়ের, যারা স্বপ্ন দেখার সাহস করে। বিশ্বাস, অধ্যাবসায় ও একতা দিয়ে কী অর্জন করা যায়, এটা তার প্রমাণ। আমরা এখানে থামছি না। পরবর্তী কয়েক মাসের প্রস্তুতি হবে কঠিন, কিন্তু আমরা চ্যালেঞ্জের জন্য প্রস্তুত।’

হোটেলরুমে ফিরে একটু গা এলিয়ে দিলেন কেউ, কেউ বা টিকটক ভিডিও বানাচ্ছেন। আবার কেউ গোছগাছ করছেন পরের দিনের ফ্লাইট ধরার জন্য। তাদের অনেকেই এখনও জাতীয় ফুটবলার হিসেবে মানিয়ে নেওয়ার লড়াই করছেন। বেশিরভাগ খেলোয়াড় সুবিধাবঞ্চিত পরিবার থেকে উঠে এসেছেন। তারা প্রশিক্ষণ, কঠোর রুটিন এবং পুষ্টি চার্টে চলার নতুন জগতে অভ্যস্ত হওয়ার লড়াই করছেন। পাঁচ তারকা হোটেলে রুম সার্ভিসের সুবিধা পেলেও কেউ কেউ আলু সেদ্ধ করছেন কেটলিতে এবং পেঁয়াজ কেটে ভর্তা বানাচ্ছেন।

আফঈদার সরল স্বীকারোক্তি, ‘আমরা এখনও আন্তর্জাতিক খাবারে অভ্যস্ত হয়ে উঠছি। এবং কখনও কখনও একটি বড় ম্যাচের পরে আমরা আমাদের মতো করে কিছু খাবার চাই, যেটা আমাদের দেশের।’

খন্দকার সাতক্ষীরার মেয়ে। ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখতে থাকেন বাবাকে দেখে। তার বাবাও ফুটবলার হতে চেয়েছিলেন। একসময় জেলা পর্যায়ে খেলতেন। আন্তর্জাতিক ফুটবলেও খেলার আকাঙ্ক্ষা ছিল। কিন্তু কঠিন বাস্তবতা মেনে পরিবারের কষ্ট লাঘব করতে স্বপ্ন জলাঞ্চলি দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে যান। ফিরে এসে সঞ্চয় ভেঙে একটি ছোট ব্যবসা শুরু করেছিলেন এবং স্থানীয় বাচ্চাদের জন্য একটি অপেশাদার ফুটবল একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। খন্দকার এবং তার বড় বোন আফরা ছিল তার প্রথম শিষ্য।

আফঈদা ফিরে গেলেন পেছনে, ‘ফুটবলের প্রতি আমার আগ্রহ আমার বাবার কাছ থেকে এসেছে। তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে মেয়েরা ছেলেদের মতোই ভালো ফুটবল খেলতে পারে, তাদের চেয়ে বেশি ভালো না হলেও। অন্যদের চেয়ে আমাদের বেশি খাটাতেন তিনি।’

ছোটবেলায় যখন দুই বোন প্রশিক্ষণ বা দৌড়াতে খুব ক্লান্ত থাকতেন, তখন তাদের বাবা হাতে কাদা নিয়ে তাড়া করতেন। খন্দকার হাসতে হাসতে স্মরণ করেন, ‘বাড়িতে তিনি আমাদের আব্বু ছিলেন, কিন্তু মাঠে তিনি আমাদের কোচ ছিলেন এবং তিনি কখনও আমাদের একদিনও ছুটি দিতেন না।’

তাদের কঠোর পরিশ্রম সার্থক হয়েছে। ১১ বছর বয়সে আফঈদাকে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের জাতীয় প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের জন্য নির্বাচিত করা হয়েছিল, যখন আফরা বক্সিংয়ে মনোনিবেশ করেছিলেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের জাতীয় বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপের সেমিফাইনালে অংশ নিয়েছিলেন আফরা।

আফঈদা বললেন, ‘আমরা সত্যিই ভাগ্যবান যে আমাদের বাবা-মার সমর্থন আছে এবং আশা করি আমাদের সাফল্য অন্যান্য মেয়েদের খেলাধুলা চালিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করবে।’

আফঈদা বলে গেলেন, ‘আমরা যেখানে আছি সেখানে পৌঁছানোর জন্য সত্যিই কঠোর পরিশ্রম করেছি। কিন্তু সঠিক সহায়তা ছাড়া এর কিছুই সম্ভব হতো না।’

Author

ট্যাগ :
জনপ্রিয় খবর
.copy_right_section { display: none; }

‘এই অর্জন শুধু আমাদের নয়, দেশের প্রতিটি মেয়ের’

আপডেটের সময়: ০৩:১৯:১৪ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২০ অগাস্ট ২০২৫

স্পোর্টস ডেস্ক : কাকডাকা ভোরে সূর্যের আলো কেবল ফুটতে শুরু করেছে। বসুন্ধরা কিংস এরেনার মাঠের পাশে একটি বাস থামলো। দরজা খুলতেই একে একে বেরিয়ে এলেন, সবার চুল শক্ত করে বাঁধা, বুট কাঁধে ঝুলছে। সবাই প্রাণোচ্ছ্বল। নেই কোনও ঘুম ঘুম ভাব। বাংলাদেশের নারী জাতীয় ফুটবল দলের জন্য এমন ঘটনা রুটিন হয়ে গেছে। সকাল সকাল উঠে অনুশীলন। সামনে যে স্বর্ণাক্ষরে ইতিহাস লেখার সুযোগ, নষ্ট করার মতো সময় নেই। স্কোয়াডের সামনের দিকে ছিলেন অধিনায়ক আফঈদা খন্দকার। সম্প্রতি বাংলাদেশকে এএফসি এশিয়ান কাপে প্রথমবার তুলতে নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি।

১৮ বছর বয়সী ডিফেন্ডার বুকভরা গর্ব নিয়ে বললেন, ‘আমি চাই আমাদের মেয়েরা তাদের উজ্জ্বল পারফরম্যান্সের স্বীকৃতি পাক এবং আমাদের সাম্প্রতিক জয় সেটাই করেছে। কিন্তু আমাদের এই তো কেবল শুরু। আমরা বিশ্বকে দেখাতে চাই, বাংলাদেশ আসলে কী করার সামর্থ্য রাখে।’

 

বাছাইপর্বে তিন ম্যাচে ১৬ গোল দিয়েছে বাংলাদেশ, খেয়েছে মাত্র একটি। তিন ম্যাচে ৯ পয়েন্ট নিয়ে ‘সি’ গ্রুপের খেলা শেষ করেছে শীর্ষে থেকে। আগামী বছর জাপান, চীন ও দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দলের সঙ্গে খেলবে। সেখানে শীর্ষে থাকতে পারলে মেয়েদের বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে খেলার সুযোগ পাবে, এমনকি অলিম্পিক গেমসে খেলার স্বপ্নও দেখতে পারে। দেশের ফুটবল যাত্রায় সেটা হবে বিরাট মাইলফলক।

ফিফা বিশ্ব র‌্যাঙ্কিংয়েও বড় লাফ দিয়েছে বাংলাদেশ। ২৪ ধাপ লাফিয়ে ১০৪তম। সবশেষ প্রকাশিত র‌্যাঙ্কিংয়ে সবচেয়ে বেশি উন্নতি করেছে তারাই

বাংলাদেশ অধিনায়ক আফঈদা খন্দকার বললেন, ‘এই অর্জন কেবল আমাদের নয়- এটা বাংলাদেশের প্রত্যেক মেয়ের, যারা স্বপ্ন দেখার সাহস করে। বিশ্বাস, অধ্যাবসায় ও একতা দিয়ে কী অর্জন করা যায়, এটা তার প্রমাণ। আমরা এখানে থামছি না। পরবর্তী কয়েক মাসের প্রস্তুতি হবে কঠিন, কিন্তু আমরা চ্যালেঞ্জের জন্য প্রস্তুত।’

হোটেলরুমে ফিরে একটু গা এলিয়ে দিলেন কেউ, কেউ বা টিকটক ভিডিও বানাচ্ছেন। আবার কেউ গোছগাছ করছেন পরের দিনের ফ্লাইট ধরার জন্য। তাদের অনেকেই এখনও জাতীয় ফুটবলার হিসেবে মানিয়ে নেওয়ার লড়াই করছেন। বেশিরভাগ খেলোয়াড় সুবিধাবঞ্চিত পরিবার থেকে উঠে এসেছেন। তারা প্রশিক্ষণ, কঠোর রুটিন এবং পুষ্টি চার্টে চলার নতুন জগতে অভ্যস্ত হওয়ার লড়াই করছেন। পাঁচ তারকা হোটেলে রুম সার্ভিসের সুবিধা পেলেও কেউ কেউ আলু সেদ্ধ করছেন কেটলিতে এবং পেঁয়াজ কেটে ভর্তা বানাচ্ছেন।

আফঈদার সরল স্বীকারোক্তি, ‘আমরা এখনও আন্তর্জাতিক খাবারে অভ্যস্ত হয়ে উঠছি। এবং কখনও কখনও একটি বড় ম্যাচের পরে আমরা আমাদের মতো করে কিছু খাবার চাই, যেটা আমাদের দেশের।’

খন্দকার সাতক্ষীরার মেয়ে। ফুটবলার হওয়ার স্বপ্ন দেখতে থাকেন বাবাকে দেখে। তার বাবাও ফুটবলার হতে চেয়েছিলেন। একসময় জেলা পর্যায়ে খেলতেন। আন্তর্জাতিক ফুটবলেও খেলার আকাঙ্ক্ষা ছিল। কিন্তু কঠিন বাস্তবতা মেনে পরিবারের কষ্ট লাঘব করতে স্বপ্ন জলাঞ্চলি দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে যান। ফিরে এসে সঞ্চয় ভেঙে একটি ছোট ব্যবসা শুরু করেছিলেন এবং স্থানীয় বাচ্চাদের জন্য একটি অপেশাদার ফুটবল একাডেমি প্রতিষ্ঠা করেন। খন্দকার এবং তার বড় বোন আফরা ছিল তার প্রথম শিষ্য।

আফঈদা ফিরে গেলেন পেছনে, ‘ফুটবলের প্রতি আমার আগ্রহ আমার বাবার কাছ থেকে এসেছে। তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে মেয়েরা ছেলেদের মতোই ভালো ফুটবল খেলতে পারে, তাদের চেয়ে বেশি ভালো না হলেও। অন্যদের চেয়ে আমাদের বেশি খাটাতেন তিনি।’

ছোটবেলায় যখন দুই বোন প্রশিক্ষণ বা দৌড়াতে খুব ক্লান্ত থাকতেন, তখন তাদের বাবা হাতে কাদা নিয়ে তাড়া করতেন। খন্দকার হাসতে হাসতে স্মরণ করেন, ‘বাড়িতে তিনি আমাদের আব্বু ছিলেন, কিন্তু মাঠে তিনি আমাদের কোচ ছিলেন এবং তিনি কখনও আমাদের একদিনও ছুটি দিতেন না।’

তাদের কঠোর পরিশ্রম সার্থক হয়েছে। ১১ বছর বয়সে আফঈদাকে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের জাতীয় প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের জন্য নির্বাচিত করা হয়েছিল, যখন আফরা বক্সিংয়ে মনোনিবেশ করেছিলেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের জাতীয় বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপের সেমিফাইনালে অংশ নিয়েছিলেন আফরা।

আফঈদা বললেন, ‘আমরা সত্যিই ভাগ্যবান যে আমাদের বাবা-মার সমর্থন আছে এবং আশা করি আমাদের সাফল্য অন্যান্য মেয়েদের খেলাধুলা চালিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করবে।’

আফঈদা বলে গেলেন, ‘আমরা যেখানে আছি সেখানে পৌঁছানোর জন্য সত্যিই কঠোর পরিশ্রম করেছি। কিন্তু সঠিক সহায়তা ছাড়া এর কিছুই সম্ভব হতো না।’

Author